সার্স-এনকোভ ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারীর আকার ধারণ করেছে।একে রোধ করতে পারে সচেতনতা।
হাতের স্বাস্থ্য, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার ও সামাজিক দূরত্ব (ন্যূনতম ৬ ফুট বা ১.৮ মিটার দৈহিক দূরত্ব) বজায় রাখা এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায়।
WHO-র মতে বাতাসের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কোন প্রমাণ নেই। যদিও নির্দিষ্ট পরিবেশে (কেন্দ্রীয় শীতাতপ ভবন, আই সি ইউ যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা হয় ব্যতিক্রম ছাড়া) বেশ কয়েক মিটার দূরত্ব পর্যন্ত বাহিত হতে পারে এবং কয়েক ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারে। খোলামেলা স্থানে হাঁচি-কাশি জনিত ড্রপলেট ৬ ফুট বা ১.৮ মিটারের মধ্যে থিতিয়ে পড়ে। এছাড়া সংক্রামিত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ জনিত কারনেও এর বিস্তার ঘটে।
সামাজিক মাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা ও অর্ধসত্য তথ্যের আতুরঘর। কিছু প্রথাগত শিক্ষিত মানুষেরা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন যা দেখে শুনে একরাশ হতাশা গ্রাস করে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে এত কম মৃত্যু কেন? যেন মনে হয় আরও আরও অনেক বেশি মৃত্যু হলে কিছু শ্রেণির মানুষ খুশি হয়। কোথাও কোন মানুষ বাইরে থেকে এলে তাঁরা মনে করেন তাঁদের বাড়িতেই যেন গৃহ কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র বানিয়ে উক্ত মানুষগুলিকে রাখা হবে? কার দ্বারা কে সংক্রামিত হবেন তা তো কেউ জানেন না,সেই তথাকথিত মানুষজন মনে হয় বাজার ঘাট করেন না ? যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উন্নাসিক মানুষদের খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন এবং ঘরে বসে সেই সব্জিওয়ালা, দুধওয়ালা, মুদিখানার মানুষদের নামে বিষোদগার করতে তাঁদের বিবেকে একটুও বাধে না !
যাঁরা ভিন রাজ্যে আটকে আছেন (পরিযায়ী শ্রমিক , ছাত্র-ছাত্রী, অসুস্থ রোগী) তাঁরা নিজ বসতবাড়িতে ফিরবে কেন সেই নিয়ে উক্ত তথাকথিত ভদ্রলোকেদের চিন্তার শেষ নেই।
সরকারের উপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই (সরকারী সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে নিশ্চয়ই সমালোচনা করা উচিত, এটা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত)। আবার কিছু ব্যক্তি আছেন তাঁরা মনে করেন সরকারের বিরোধিতা করা মানে দেশদ্রোহী, যখন তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলে যাওয়ার কথা বলেন।
কতশত মানুষ ভিনরাজ্যে কাজ করতে যান, তাঁদের সন্তান-সন্ততি স্কুল-কলেজে পড়েন তাঁদের আদি বসবাসস্থলেই।
সেই ছেলে মেয়ের বা কারুর স্বামী যদি ভিন রাজ্যে না খেতে পেয়ে মারা যান, হাঁটতে হাঁটতে মারা যান তবুও সেই পরিযায়ীদের ঘরে ফেরা চলবে না, সেই তথাকথিত সুশীল সমাজ তাই মনে করেন।
যেসব ডাক্তার বা নার্স প্রমুখ স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা দিয়ে চলেছেন, যাঁদের জন্য থালা-বাটি, কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়িয়ে সন্মান জানালেন, সেই মানুষদেরকেই আবার তাঁর নিজ আবাসে প্রবেশে বাঁধা দেন তাঁরাই!
তখন দেশপ্রেম অপেক্ষা সামাজিক ঘৃণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাঁদের। তখন তাঁরা ভুলে যান যে ওই মানুষগুলো তাঁর স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা কারুর সঙ্গেই মিশতে পারেন না কারণ তাঁরাও জানেন না যে তাঁরা ভাইরাসের ইনকিউবেশন’ বা প্রাথমিক লালনকাল পর্যায়ে আছেন কিনা ?
আরও একটি বিষয়ে ওই সবজান্তা মানুষগুলি মতবাদ ব্যক্ত করেন কেন অমুককে সরকারী কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো না ? এমন ভাব যেন সরকার কিচ্ছু জানেন না।
একবারও তাঁরা ভেবে দেখেছেন তাঁদের বাড়ির কেউ সাধারণ জ্বর বা কোভিড-এর উপসর্গ দেখা দিলে তাঁরা সরকারী কোয়ারেন্টাইন না হোম কোয়ারেন্টাইন কোনটা বেছে নেবেন ?
মনে রাখতে হবে সরকার যখন হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠান তখন নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে ICMR ও WHO-র গাইডলাইন মেনে পাঠান।
যাঁরা False Positive (আসলে করোনা নেই, কিন্তু টেস্ট দেখালো positive) বা সুস্থ ব্যক্তি তাঁরা সরকারী কোয়ারেন্টাইন বা কোভিড হসপিটালে গেলে তো প্রকৃতই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। অথবা তাঁরা কি এটা ভেবে দেখেছেন যে যাঁর করোনা টেস্ট Negative এলো সে তো False Negative-ও (আসলে করোনা আক্রান্ত কিন্তু টেস্ট দেখালো Negative) হতে পারেন (কারণ কোন টেস্ট কিটই ১০০% Accurate হতে পারে না)এবং নিজেকে করোনা মুক্ত মনে করে আরও মানুষকে ছড়াতে থাকলেন।
সুতরাং কে বাহক আর কে নন এটা জানার যেহেতু চট জলদি উপায় নেই (কেননা ১৩০ কোটি মানুষের পরীক্ষা পরিকাঠামো ভারতের নেই, আর দিনে ১ লক্ষ পরীক্ষা হলেও সবার টেস্ট করতে অন্তত: ৩৫ বছর লাগবে)।
তাই ঘৃণা নয়, মানবিক হোন, হেট্ স্পিচ দানে বিরত থাকুন। গৃহে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পাশাপাশি মনটাকেও পরিষ্কার করুন।
লেখক ডঃ নজরুল ইসলাম (সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ,কোচবিহার)