গত মাসের প্রথমদিকেই আমার গ্রামের প্রায় ৩৫জন অধিবাসীকে করোনা সাস্পেক্ট করে কোয়ারেন্টাইন করা হয়।
তারপর আমরা খবর পাই যে গ্রামের আরেকজন করোনা পজিটিভ হিসেবে আইসোলেটেড সরাসরি হাওড়ার কোনো হাসপাতালে কর্মরত অবস্থা থেকেই। এবং যার রেশ ধরে এখানে তাঁর আত্মীয় স্বজনসহ প্রতিবেশিদের কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে।
কোয়ারেন্টাইনের জন্য সাস্পেক্টেডদের তুলতে প্রশাসনকে খানিক বেগ পেতেও হয়। অদ্ভুতভাবে গ্রামের জীবনযাত্রা হঠাৎই পাল্টে যায় এবং এই ইস্যুতে গোটা গ্রাম দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একটি শিবিরের দাবী উক্ত ৩৫ জন কেন গ্রামে ঢুকেছেন, তাঁদের সামান্য দায় দায়িত্ব কি নেই গ্রামের প্রতি? এই নিয়ে নানান মন্তব্য নানান সমালোচনা। আরেকটি শিবির ছোটো হলেও তাঁরা দাঁড়িয়েছেন কোরেন্টাইন সাস্পেক্টেডদের পাশে, যাতে তাঁদের কোরেন্টাইন অবস্থায় কোনোরকম সমস্যা/খামতির সম্মুখীন হতে না হয়। সাথে গ্রামের লোকজনকে বোঝানো যাতে বাকিরাও এই ইস্যুতে সবাই যেন সাস্পেক্টেডদের পাশে থাকে, আমি এবং আমার বন্ধুরা এই ছোটো দলটিতে ছিলাম।
পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলি থেকে শুরু করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এমনকি কিছু লোকাল নিউজ মিডিয়াতেও এই বিষয়ে নানান বিভ্রান্তিমূলক গুজব মিশ্রিত সমালোচনা ছড়াতে থাকে। কিন্তু আমরা গ্রামবাসীরা কোনভাবেই বিষয়টিকে হিন্দু-মুসলমান ইস্যুতে কনভার্ট করিনি এমনকি মনেও আসেনি বা রাজনৈতিক রঙও লাগতে দিইনি। যদিও সাস্পেক্টেড সবাই অবাঙালি দলিত হিন্দু ছিলেন (যাঁরা মুসলমানদের মতোই রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন বর্তমানে)।
উল্টোদিকে যে কোনো মুসলমান ব্যক্তি করোনা সাস্পেক্টেড বা পজিটিভ হলেই বিজেপি সহ তাদের সহযোগী সমস্ত দল কোমর বেঁধে নেমে পরছে তাদের নোংরা রাজনীতি নিয়ে। তেমনি গতকালও একটি ঘটনার কথা শুনলাম করোনাক্রান্ত এলাকার। যেখানকার কিছু মুসলমান ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইন করার পর একইরকম এলাকায় দুটি শিবির তৈরি হয়ে যায় এবং অদ্ভুতভাবে একটিতে মুসলমান অপরটিতে হিন্দু(যদিও ঘটনা চক্রে উভয় পক্ষই অবাঙালি)। মুসলমানদের সামজিকভাবে বয়কট করে নানান ভিত্তিহীন জল্পনা এবং গুজব ছড়াতে থাকে, যার সিংহভাগই ফেবু, হোয়াটসঅ্যাপ এর দৌলতে।
মুসলমানদের পাবলিক টয়লেট, বাথরুম (যেটা জুটমিলের তৈরি) এবং সরকারি জলের কল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় স্থানীয়দের কলকাঠিতে এমনকি রাস্তাও হিন্দু মুসলমানে বিভক্ত হয়ে যায়। সেখানে করোনা সাস্পেক্ট ইস্যু গৌণ হয়ে হিন্দু-মুসলমান ইস্যুই প্রাধান্য পেতে থাকে। পরিণতিতে দুটি শিবিরের মাঝের ফাটল বাকবিতণ্ডা থেকে মারামারিতে রূপান্তরিত হয় এবং প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে এরকম একটা প্রচার সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো গেছে। তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি যে দলেরই ভোটার হোক না কেন অধিকাংশ মানুষ এটা বিশ্বাস করছে। নিজে থেকেই লোকে ব্যারিকেড করে এলাকা থেকে মুসলমান পাড়াগুলো আলাদা করে দিচ্ছে। দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করছেনা অনেক জায়গায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝামেলার সূত্রপাত হচ্ছে এখান থেকেই।
এখন প্রশ্ন এসব করে কি লাভ কাদের লাভ মানুষকে বুঝতে হবে।
উপরের দুটি ঘটনার মধ্যে মানসিকতার ফারাক বিচার করুন। বিভেদের রাজনীতি আর কদ্দিন মাননীয় মহাশয়/মহাশয়া?
#মানুষকে_বাঁচতে_দিন_এবং_বাঁচানোর_চেষ্টা_করুন।
সামিম আহমেদ,হুগলী।
আবার এবিষয়ে সমাজকর্মী জিম নওয়াজ বিস্তারিত লিখেছেন-
গত দু’তিনদিন ধরে হুগলির চন্দননগরের তেলানিপাড়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এবিষয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে এসেছে। তথ্যগুলো ভেরিফিকেশনের কাজ চলছে। ভেরিফিকেশনের পরে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশ করবো বলে স্থির করেছি। আজকের এই পোস্টটি সাংসদ অর্জুন সিং এর ফেসবুক ভিডিও পোস্ট এর ফ্যাক্ট চেক বিষয়ক।
গত ১১ই মে বিকেল ৪টে ৩৪ মিনিটে বিজেপির সাংসদ অর্জুন সিং ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেই ভিডিওটিতে একজন রক্তাক্ত ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে । ভিডিও পোস্টটির লিঙ্ক কমেন্টে এবং আমার এই পোস্টে তার স্ন্যাপশট রইল।

অর্জুন সিং তার ফেসবুক পোস্টে সেই রক্তাক্ত ব্যক্তিকে হিন্দু বলে উল্লেখ করেছেন। এবং দাবি করেছেন, ‘দুধেল গাই’ মুসলমানরা এভাবেই তেলানিপাড়ায় হিন্দুদের রক্ত ঝরাচ্ছে।
আসুন, এবার অর্জুন সিং এর পোস্টের ভিডিওতে যে রক্তাক্ত ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে তার আসল পরিচয় একবার খতিয়ে দেখে নেওয়া যাক।
ভিডিওটিতে যে রক্তাক্ত ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে তার আসল নাম মঞ্জুর আলম। বয়স প্রায় ৫৫ বছর। পেশায় ভদ্রেশ্বর জুটমিলের শ্রমিক। ভদ্রেশ্বর জুটমিল কোয়ার্টারের ১২নম্বর লাইনে সপরিবারে থাকেন। গত ১০ তারিখ ইফতারের পরে মাগরিবের নামাজ পড়ে মঞ্জুর কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ কিছু দুষ্কৃতি তরোয়াল হাতে মঞ্জুরের কাছে এসে বলতে শুরু করেন,
“তোরা মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছিস। তোরা এই কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যা। নাহলে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।”
মঞ্জুর কোয়ার্টার ছেড়ে যেতে রাজি না হতেই দুষ্কৃতিরা জয়শ্রীরাম শ্লোগান দিয়ে এলোপাথাড়ি তরোয়ালের কোপ মারতে শুরু করে। আর্তনাদ শুনে মঞ্জুর আলমের সন্তান বছর ত্রিশ বয়সী মুহাম্মদ আজাদ বেরিয়ে আসেন। বাবাকে বাঁচাতে যেতেই আজাদকেও কোপানো হয়। এরপর স্থানীয় মানুষরা রুখে দাঁড়ালে দুষ্কৃতিরা পালিয়ে যায়। মঞ্জুর আলম এবং পুত্র মুহাম্মদ আজাদকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মুসলিম ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের রক্তাক্ত করে, রক্তাক্ত ব্যক্তিদের হিন্দু বলে চালিয়েছিলেন অর্জুন সিং। আক্রমণের দায় চড়িয়েছিলেন মুসলমানদের উপর। দাঙ্গাবাজ অর্জুন সিং ধরা পড়ে গেলেন। হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা আক্রান্ত মঞ্জুর আলম এবং মুহাম্মদ আজাদ এর সুস্থতা কামনা করি।
জিম নওয়াজ